মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো শারীরিক সুস্থতা। পবিত্র রমজান মাসে দীর্ঘ পানাহার বিরতিতে থাকায় রোজাদার ঔষধ সেবন ছাড়াই লাভ করে থাকে সতেজতা ও সুস্থতা। যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রমাণিত। রমজানে প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ অনুগ্রহ লাভ করে থাকেন। গবেষণা করে দেখা গেছে, রোজায় মানুষের স্বাস্থ্যগত প্রভূত উপকার হয়। এর রয়েছে শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষতার নানা দিক। রোজাদার দিনের বেশির ভাগ সময় না খেয়ে থাকেন। এর ফলে তার শরীরে জমে থাকা ক্ষতিকারক টক্সিন কিডনির মাধ্যমে শরীর থেকে বের হওয়ার সুযোগ পায়। শরীরকে বিষমুক্ত করার একটি কার্যকর উপায় সিয়াম তথা রোজা। যারা ওজন কমাতে চান, তারা সহজেই এ সময়টা কাজে লাগাতে পারেন। কারণ, রোজা রাখার পাশাপাশি ইফতার ও সাহরিতে পুষ্টিকর খাবারকে প্রাধান্য দিলে খুব সহজেই ওজন কমানো যেতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, রমজানে নিয়মিত রোজা রাখার ফলে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা যেমন উচ্চ কোলেস্টেরল, হৃদরোগ ও স্থূলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। রোজায় পেট খালি থাকার কারণে খাবার হজমের অ্যাসিড এই সময় ধীরগতিতে নিঃসরিত হয়, যা হজমের সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রোজার কোনো বিকল্প নেই। কারণ দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকার ফলে শরীরে কোলেস্টেরল ও গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যায়। এ ছাড়া যেকোনো নেশাগ্রব্য থেকে মুক্তি পেতেও রোজা কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
রোজার শারীরিক উপকারিতার সঙ্গে রয়েছে মানসিক উপকারিতাও। রোজার গুরুত্ব অনুধাবন করে মার্কিন চিকিৎসক আইজাক জেনিংস বলেছেন, যারা আলস্য ও গোঁড়ামির কারণে এবং অতিভোজনের কারণে নিজেদের সংরক্ষিত জীবনীশক্তিকে ভারাক্রান্ত করে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়, রোজা তাদের এ বিপদ থেকে রক্ষা করে। রোজা রাখার ফলে আমাদের শরীর নানা ধরনের চাপ নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। ফলে রোজাদার ব্যক্তি কখনো খিঁচুনি এবং মানসিক অস্থিরতার মুখোমুখি হন না। তবে ইফতারে ও তারপরে ভাজাপোড়া খাওয়া থেকে বিরত থাকা দরকার। পুষ্টিকর নরম খাবার (ফলমূল-শাকসবজি) বেশি বেশি খেতে হবে। আর প্রচুর পরিমানে পানি খেতে হবে। সাথে স্যালাইন ও গ্লূকোজ বা এনার্জি খাওয়া যেতে পারে।
রোজা ভঙ্গের মাসয়ালা : যেসব কারণে রোজ ভঙ্গ হয় না :
রোজার আরবি প্রতিশব্দ ‘সাওম’। যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায়, ‘সাওম বলা হয় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোজা ভঙ্গকারী কাজ থেকে বিরত থাকা’।
আজ আমরা জেনে নেব- যেসব কাজের কারণে রোজা ভঙ্গ হয় না :
ক) ভুল করে (অনিচ্ছাকৃত) কোনো কিছু খেয়ে ফেললে রোজা ভঙ্গ হবে না [বুখারি শরিফ ১/২৫৯]। খ) মশা-মাছি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত পেটের ভেতর ঢুকে গেলেও রোজা ভাঙবে না [মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ৬/৩৪৯]। গ) অনিচ্ছাকৃত বমি হলে [এমনকি মুখ ভরে হলেও] রোজা ভাঙবে না। তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজেই ভেতরে চলে গেলেও রোজা ভাঙবে না [তিরমিজি ১/১৫৩]। ঘ) রোজার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করলে রোজা নষ্ট হবে না। তবে রোজা স্মরণ হওয়ামাত্র পানাহার ছেড়ে দিতে হবে [মুসলিম ১/২০২]। ঙ) দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে পেটের মধ্যে না গেলে রোজা ভাঙবে না [শামি ৩/৩৬৭]। চ) কোনো খাদ্যদ্রব্য বুট বা ছোট ছোলার কম পরিমাণ যদি দাঁতের সঙ্গে লেগে থাকে ও গলার ভেতর চলে যায়, তাহলে রোজা ভাঙবে না [হিন্দিয়া ১/২০২]। হ্যাঁ, দাঁত থেকে বের করে হাতে নিয়ে স্বেচ্ছায় খেয়ে ফেললে রোজা নিশ্চিতভাবে ভেঙে যাবে [হিন্দিয়া ১/২০২]। ছ) কুলি করার পর পানির অবশিষ্ট আর্দ্রতা থুথুর সঙ্গে গিলে ফেললে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না [হিন্দিয়া ১/২০৩]। জ) ঘাম অথবা চোখের অশ্রুর দু-এক ফোঁটা যদি অনিচ্ছায় মুখে চলে যায়, তাহলে রোজা নষ্ট হবে না [হিন্দিয়া ১/২০৩]। ঝ) কানের ময়লা বাইর করার দ্বারাও রোজা ভাঙবে না [মারাকিল ফালাহ ৩৪২]। ঞ) নাক এত জোরে সাফ করা, যার ফলে কফ গলার মধ্যে চলে যায়, তাহলেও কোনো সমস্যা নেই [দুররে মুখতার ৩/৩৭৩]। ট) রোজা অবস্থায় আতর বা ফুলের ঘ্রাণ নিলেও কোনো সমস্যা নেই [মারাকিল ফালাহ, ৩৬১]। ঠ) শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোজা ভাঙবে না, বরং তা বৈধ [মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক ৪/৩১৩]। ড) যদি রোজাদারের গোসল করার সময় অথবা বৃষ্টিতে ভেজার সময় কানের মধ্যে অনিচ্ছায় পানি চলে যায়, তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে রোজা নষ্ট হবে না [ফাতহুল কাদির ২/৩৪৭]। ঢ) সুস্থ অবস্থায় রোজার নিয়ত করার পর যদি অজ্ঞান, অচেতন বা পাগল হয়ে যায়, তাহলে রোজা নষ্ট হবে না [সুনানে কুবরা বায়হাকি ৪/২৩৫]। ণ) নিদ্রায় স্বপ্নদোষ হওয়া ত) স্ত্রীর প্রতি দৃষ্টিপাত করায় বীর্যস্খলন ঘটলে। থ) তৈল ব্যবহার করলে। দ) সুরমা ব্যবহার করলে। ধ) চুমু খেলে। ন) মিসওয়াক করলে। (যে কোনো সময় হোক, কাঁচা হোক বা শুষ্ক মিসওয়াক হোক)। প) মুখে থুথু আসলে গিলে ফেলা। ফ) বিশেষ প্রয়োজনে ইনজেকশন নিলে। ব) রোজা অবস্থায় দাঁত উঠালে; (শর্ত হলো কণ্ঠনালীর ভিতর রক্ত না যাওয়া)।
রোজ ভঙ্গের কারণ : যে সকল কাজে রোজা ভঙ্গ হয় :
ক) আহার অথবা পানকরা। খ) স্ত্রী সহবাস করা। গ) ভুলে খাওয়া বা পান করার পর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে আবার ইচ্ছাকৃতভাবে খাওয়া বা পান করা। (ফাতওয়া শামি, খণ্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৭৫) ঘ) বিড়ি-সিগারেট বা হুঁকা সেবন করা। (জাওয়াহিরুল ফিকাহ, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ৩৭৮) ঙ) কাঁচা চাল, আটার খামির বা একত্রে অনেক লবণ খাওয়া। (ফাতওয়া আল-হিন্দিয়্যা, খ- : ০১, পৃষ্ঠা : ১৯৯) চ) এমন কোনো বস্তু খাওয়া, যা সাধরণত খাওয়া হয় না। যেমন- কাঠ, লোহা, কাগজ, পাথর, মাটি, কয়লা ইত্যাদি। (ফাতওয়া আল-হিন্দিয়্যা, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ২০২; জাওয়াহিরুল ফিকাহ, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ৩৭৮) ছ) নিজের থুতু হাতে নিয়ে গিলে ফেললে। (ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়্যা, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ২০২) জ) ভুলে স্ত্রী সম্ভোগের পর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে— আবার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস সম্পর্ক করা। (ফাতওয়া শামি, খণ্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৭৫) ঝ) কানে বা নাকের ছিদ্র দিয়ে তরল ওষুধ দেওয়া। (ইমদাদুল ফাতাওয়া, খণ্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ১২৭) ঞ) দাঁত দিয়ে রক্ত বের হলে যদি তা থুতুর চেয়ে পরিমাণে বেশি হয় এবং কণ্ঠনালিতে চলে যায়। (ফাতাওয়া শামি, খণ্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৬৭) ট) মুখে পান দিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া এবং এ অবস্থায় সুবহে সাদিক করা। (ইমদাদুল ফাতাওয়া, খণ্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ১৭২) ঠ) হস্তমৈথুন করা। (ফাতাওয়া দারুল উলুম দেওবন্দ, খণ্ড : ০৬, পৃষ্ঠা : ৪১৭) ড) রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় কুলি কিংবা নাকে পানি দেওয়ার সময় কণ্ঠনালিতে পানি চলে যাওয়া। (আহসানুল ফাতাওয়া, খণ্ড : ০৪, পৃষ্ঠা : ৪২৯) ঢ) কাউকে জোর-জবদস্তি করে পানাহার করানো। (ফাতাওয়া হিন্দিয়্যা, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ২০২) ণ) রাত মনে করে সুবহে সাদিকের পর সাহরি খাওয়া। (জাওয়াহিরুল ফিকাহ, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ৩৭৮) ত) ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা বা বমি আসার পর তা গিলে ফেলা। (ফাতহুল কাদির, খণ্ড ০২, পৃষ্ঠা : ৩৩৭) থ) সূর্যাস্ত হয়ে গেছে মনে করে ভুলে দিনে ইফতার করা। (বুখারি, হাদিস : ১৯৫৯)
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সুস্থতার সাথে রোজার মাসয়ালা জেনে ও যথাযথ হক আদায় করে পবিত্র রমজানের সবকটি রোজা রাখার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাস, যশোর।