লোগো
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদনে ছাত্র-জনতার ওপর শেখ হাসিনা সরকারের ভয়াবহ নিপীড়নের তথ্য উঠে এসেছে। আন্দোলন দমনের নামে সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ হয়েছে জুলাই-আগস্ট মাসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই থেকে আগস্ট মাসে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন ১ হাজার ৫৮১ জন। হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা গুম, গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তারের পর নির্যাতন চালায় আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর। শুক্রবার মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের দেয়া মানবাধিকার সংক্রান্ত ত্রৈমাসিক (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদনে এ তথ্য দেয়া হয়েছে।
অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকারকর্মীদের পাঠানো প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তিন মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে এই মানবাধিকার সংগঠনটি। প্রতিবেদনটি তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে কর্তৃত্ববাদী শাসক হাসিনার ১লা জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত সময়ের উল্লেখযোগ্য অংশ। দ্বিতীয় ভাগে ৯ই আগস্ট থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪ অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের উল্লেখযোগ্য অংশ। তৃতীয় ভাগে ১লা জুলাই থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো। চলতি বছরের ৫ থেকে ৮ই আগস্ট পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলা হয়, কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের সময়ে জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার কারণে সাংবাদিকরা হত্যা, হামলা, মামলা এবং হয়রানির শিকার হয়েছেন। এই আন্দোলনের খবর সংগ্রহের সময় পুলিশ ৫ জন সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করে। ১৮ই জুলাই ঢাকা টাইমস নামে একটি নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক হাসান মেহেদী, ভোরের আওয়াজ পত্রিকার প্রতিবেদক শাকিল হোসাইন এবং নয়াদিগন্তের সিলেট প্রতিনিধি আবু তাহের মোহাম্মদ তুরাব পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ১৯শে জুলাই ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও সেন্ট্রাল রোডের পাশে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে নিহত হন সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়। ৫ই আগস্ট সিরাজগঞ্জের দৈনিক খবরপত্রের সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিক পুলিশের গুলিতে নিহত হন। প্রতিবেদনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলা হয়, গত ১লা জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত হাসিনা সরকার জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে খর্ব করে। আন্দোলনের সময় সরকারি নির্দেশে ১৭ই জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ই জুলাই রাত ৯টায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। ২৮শে জুলাই ১০ দিন পর বেলা তিনটা থেকে মোবাইল ইন্টারনেট চালু করা হয়। তবে বেশ কিছুদিন বন্ধ রাখা হয় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটকসহ বিভিন্ন সেবা।
রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ২৫৪
দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৫৪ জন নিহত হয়েছেন। এ সময় এই ধরনের সহিংসতায় আহত হয়েছেন ৮ হাজার ২৯৬ জন। এরমধ্যে চলতি বছরের ১ থেকে ৫ই আগস্ট সবচেয়ে বেশি ৯৩ জন রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হন। আর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর (৯ই আগস্ট থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৫২ জনের। অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৬৭ জন গণপিটুনিতে নিহত হন। এরমধ্যে ১লা জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত ৩৬ জন এবং ৯ই আগস্ট থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩১ জন নিহত হন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই আন্দোলনকে বিগত সরকার কঠোর হাতে দমন করার নামে তার সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করা হয়। এই সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করার জন্য জাতিসংঘের নামযুক্ত সাঁজোয়া যান ব্যবহার করা হয়।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এই সময় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। এতে শিশুসহ ১৫৮১ জন নিহত, ১৮ হাজারের বেশি আহত এবং ৫৫০ জনের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে এই সংখ্যা আরও বেশি।