Banglar Chokh | বাংলার চোখ

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে:দ্য ডিপ্লোম্যাট

আন্তর্জাতিক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ০০:১৭, ২৯ নভেম্বর ২০২৩

সর্বশেষ

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে:দ্য ডিপ্লোম্যাট

.

২৪ মে মার্কিন সরকার ঘোষণা করে, 'বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত যে কোনো ব্যক্তি এবং তাদের নিকটবর্তী পরিবারের সদস্যদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।'
 
নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয় তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপ দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের মধ্যে এই ঘোষণাটি সর্বশেষ।

বাংলাদেশে ৭ই জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচন হবে। এখন বেশ কয়েক মাস ধরে বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে  আওয়ামী লীগকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তবে আ.লীগ সরকার এ দাবি মানতে পারেনি। বরং বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন জোরদার করেছে।

বেসরকারী সংস্থা সুজনের সেক্রেটারি বদিউল আলম মজুমদার যেমন উল্লেখ করেছেন, ''বাংলাদেশের অগণতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী সরকার নাগরিকদের দাবির প্রতি সাড়া না দেয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের ওপর চাপ দিচ্ছে। ২০১৮ সালে, প্রধানমন্ত্রী একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে আগের রাতেই  ভোট হয়ে গিয়েছিলো।''  'নির্বাচনে কারচুপি' আজ অস্বাভাবিক কিছু নয়, আইনের শাসনের জন্য একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করতে  সরকারের ধারাবাহিক ব্যর্থতার ফলাফল। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে না।

নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগ  ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কাজ করছে। আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় অনুগত ও নিয়োগপ্রাপ্তদের ভিড়ে পূর্ণ। আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনের জেরে আজ  গণমাধ্যমের অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা ও শ্রম অধিকার সীমিত। হংকং-ভিত্তিক এশীয় মানবাধিকার কমিশনের মতে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বাংলাদেশে ৬২৩ জন বলপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন, যেখানে কমপক্ষে ২৬৫৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার।

যদিও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার দেশের অভ্যন্তরীণ কাজ হওয়া উচিত, তবুও এই অন্ধকার পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশিরা তাদের দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আশায়  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক বাংলাদেশি বিশ্বাস করেন যে, দেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার এবং রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে ঢাকার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের লিভারেজ রয়েছে।
 
এটি শিক্ষা, গবেষণা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তিতে নেতৃস্থানীয় সহযোগী। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরক্ষায় বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং সামাজিক উন্নয়ন উদ্যোগে দেশের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ  অবদান রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৭ সালে একটি সমঝোতার মধ্যস্থতায়  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল যার ফলে বিএনপিপন্থী তত্ত্বাবধায়ক সরকার সরে যায়, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় উত্থানকে সহায়তা করে। তার সরকার ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে দুটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন তত্ত্বাবধান করেছিল, যে দুটিতেই তিনি জয়লাভ করেছিলেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকারের চরম অপব্যবহারের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এই পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন অনেকে। কারণ গণতান্ত্রিক অধিকার এবং নাগরিক স্থানগুলিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বলপূর্বক গুমের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

তবে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে চাপ দেয়ার লক্ষ্য অর্জনে ভিসা সীমাবদ্ধতা নীতি ব্যর্থ হতে পারে। এ ধরনের নীতির চাপে আওয়ামী লীগ সরকার কয়েকজন কর্মকর্তাকে অপসারণ করলেও, দলীয় অনুগতদের নিয়ে গোটা সিস্টেমে এতটাই ভরাডুবি অবস্থা যে আরও অনেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনে কারচুপি করার জন্য তৈরি হয়ে আছে। বিদেশী সরকারের নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য চাপ সত্ত্বেও, শেখ হাসিনা বিভিন্ন বিষয়ে তার অবস্থান থেকে সরে আসতে অস্বীকার করেছেন। তিনি অধিগ্রহণ এবং ক্রস-সার্ভিসিং চুক্তি (ACSA) এবং সাধারণ সামরিক তথ্য নিরাপত্তা চুক্তির (GSOMIA) এর মতো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছেন।

আওয়ামী লীগ সরকার তথ্য স্থানীয়করণ নীতি পরিবর্তন করতে অস্বীকার করেছে; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA) এবং ডেটা সুরক্ষা আইন (DPA) এর মতো আইনগুলোর অধীনে প্রধান দমনমূলক বিধানগুলো রয়ে গেছে। উপরন্তু, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তার  দৃষ্টিভঙ্গিতে মাঝে মাঝে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ত  থাকার বিষয়টি বাদ দেয়া হয়েছে, পরিবর্তে এই বিষয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়াও, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মিডিয়ার স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, নিরপেক্ষ আউটলেটগুলো কর্পোরেট রাজস্ব তৈরিতে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। বেশিরভাগ গণমাধ্যম সরকারপন্থী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ এখন এমন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে,   প্রধানমন্ত্রী চাইলেও এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। আসলে শেখ হাসিনার ক্ষমতা ধরে রাখার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবার অবৈধ স্বার্থ জড়িত।

ফলস্বরূপ, একটি সত্যিকারের অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাংলাদেশের সমসাময়িক ইতিহাসের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। যে নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হিসেবে স্বীকৃত ছিল, সেগুলো একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।

বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাব সীমিত করতে চীন ও রাশিয়া একত্রিত হয়েছে। রাশিয়া সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনাকে চাপ দেয়ার মার্কিন প্রচেষ্টাকে ‘নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ’ এবং ‘একটি স্বাধীন দেশে নব্য-ঔপনিবেশিকতা ও নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের আরেকটি প্রচেষ্টা’ হিসাবে বর্ণনা করেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় এবং বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করতে চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করে।’

 আওয়ামী লীগপন্থী অবস্থান থেকে ভারতের কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.কে. আবদুল মোমেন স্বীকার করেছেন যে, ‘বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার তা করার জন্য তিনি ভারতকে অনুরোধ করেছিলেন।’ পশ্চিমা দেশগুলো সংকট নিরসনে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সংলাপের পরামর্শ দিচ্ছে, যদিও  ক্ষমতাসীন দল তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তাছাড়া বিএনপির প্রায় সব সিনিয়র নেতাকে গ্রেফতার বা বন্দি করে রাখা হলে গঠনমূলক সংলাপ সম্ভব হবে না। বিরোধী দল দেশব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও খাদ্যমূল্য বৃদ্ধিতে জর্জরিত  জনসাধারণের থেকে  নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছে।

এই অচলাবস্থা বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ শাসনকে চাপ দিতে তার পদক্ষেপ প্রয়োগে বিলম্ব করছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ? তারা  কি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনে সত্যিই আগ্রহী? নাকি নিছক চাপপ্রয়োগ করে তারা  বর্তমান সরকারের কাছ থেকে ছাড় পেতে চাইছে?

(ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক।  তার বেশ কয়েকটি বই রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশ’ এবং ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির ৫০ বছর’।)

সর্বশেষ

জনপ্রিয়